পশ্চিমবঙ্গ সংবাদদাতা:বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংয়ের ঘনিষ্ঠ মণীশ শুক্লাকে রবিবার ভরসন্ধ্যায় ভিড়ে ঠাসা কলকাতার বিটি রোডের ওপর গুলি করে খুন করা হল। ব্যারাকপুরের বিজেপি স্ট্রংম্যান হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই নেতা। মণীশ শুক্লাকে তৃণমূলই খুন করিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিজেপি। তবে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত মুখ্যসচিব ও ডিজি–কে তলব করে পাঠিয়েছেন স্বয়ং বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। পুলিশের মদতে তৃণমূল এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং। একই অভিযোগ জানিয়েছেন বিজেপি নেতা অরবিন্দ মেননও। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় এই খুনের ঘটনা এবং পুলিশের ভূমিকা তদন্ত করে দেখার জন্য সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ মণীশ শুক্লা টিটাগড় থানার কাছে দলের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন বাইকে চেপে বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতী এসে সেখানে থামে। তার পর খুব কাছ থেকে পর পর গুলি করে মণীশকে। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। জানা গিয়েছে, মণীশ শুক্লাকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তাঁর সঙ্গী গোবিন্দ। এই ঘটনায় ওই এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। টিটাগড় থানার নাকের ডগায় এমন ঘটনা ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিটি রোডের ধারে যে জায়গায় মণীশ দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেটি টিটাগড় থানা এবং পুরসভার মাঝামাঝি। ঘটনার পর এলাকায় পুলিশ আসে। পুলিশকে দেখেই বিজেপি কর্মী–সমর্থকরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তখন পুলিশ লাঠিচার্জ করে বিজেপি কর্মীদের সরিয়ে দেয় বলে অভিযোগ।
পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের সন্দেহ, খুনিরা অনেকদিন ধরেই এই ঘটনার পরিকল্পনা করেছিল। যদিও স্থানীয়দের বেশ কয়েকজন পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার ঠিক আগেই তৃণমূলের একটি ধিক্কার মিছিল যায়। মিছিলটি চলে যাওয়ার ঠিক পরই সেই মিছিলের পেছন থেকে বাইকে বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতী এসে হাজির হয় বিজেপি কার্যালয়ের সামনে। তারাই গুলি করে মণীশকে। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, দুষ্কৃতীদের আমরা চিনতে পেরেছি। তাদের নামও জানি। ঠিকানাও জানি। সে কথা পুলিশকে বলেওছি। কিন্তু পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেনি। বরং বিজেপি কর্মীদের ওপরেই তারা লাঠিচার্জ করেছে। ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে ১২ ঘণ্টার বন্ধের ডাক দিয়েছে বিজেপি। খুনের ঘটনার পরই বিটি রোড অবরোধ করেন বিজেপি কর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই অঞ্চলে নামানো হয়েছে কমব্যাট ফোর্স। গোটা এলাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে রয়েছে। ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী।
ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রাজ্যের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় স্বয়ং। রবিবার বেশি রাতে তিনি টুইট করে জানিয়েছেন, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা যে ঠিক নেই, এই ঘটনা তার প্রমাণ। ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে অতিরিক্ত মুখ্যসচিব এবং ডিজি–কে সোমবার সকাল দশটায় রাজভবনে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। ঘটনার পর বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় অভিযোগ করেন, ‘টিটাগড় থানার সামনে খুন করা হয়েছে বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লাকে। অনেক দিন ধরেই অর্জুন সিং সেখানকার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা এবং যুগ্ম কমিশনার অজয় ঠাকুরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আজকের ঘটনার পর আমি সিবিআই তদন্ত দাবি করছি। সেই সঙ্গে পুলিশের ভূমিকারও তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করছি।’
বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং বলেছেন, ‘তৃণমূল এবং পুলিশ মিলিত ভাবে আমাদের খুন করার চক্রান্ত করেছে। তারই একটি ঘটনা ঘটেছে আজ। মণীশকে ঘিরে ১৪–১৫ রাউন্ড গুলি চালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ১২টি গুলি লেগেছিল মণীশের শরীরে। এই ঘটনা পুলিশের মদতে ঘটিয়ে তৃণমূলই।’ তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, থানার সামনে কী করে ১৫–১৬ জন দুষ্কৃতী বাইকে এসে জড়ো হয়, গুলি চালায় এবং পালিয়ে যায়? পুলিশ কি কিছুই জানত না? রবিবার সারাদিন অর্জুন সিংয়ের সঙ্গে হাওড়ায় ছিলেন মণীশ। সন্ধ্যায় ফিরতেই তিনি খুন হয়ে গেলেন থানার সামনেই। তা হলে থানা থেকে যাঁরা দূরে থাকেন, তাঁদের অবস্থা যে কতটা সঙ্গীন, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাঁর অভিযোগ, ‘মণীশের খুনের ষড়যন্ত্রে পুলিশ পুরোপুরি জড়িত।’
যদিও তৃণমূলের স্থানীয় নেতা বিজেপির সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই ঘটনা বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই ঘটেছে। এর সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগ নেই। তৃণমূল খুনের রাজনীতি করে না। উল্লেখ্য, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে ‘স্ট্রংম্যান’ হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত খড়দার বাসিন্দা মণীশ। বাম জমানার শেষ দিকে তড়িৎ তোপদার ব্যারাকপুরের সাংসদ থাকার সময়ই এলাকায় যুবনেতা হিসাবে পরিচিতি হয়েছিল তাঁর। এর পর তৃণমূল যুব কংগ্রেসের নেতা হিসাবে গোটা শিল্পাঞ্চলেই তিনি সক্রিয় ছিলেন। পরে ভাটপাড়ার তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহের ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত হন। অর্জুন সিং বিজেপিতে যোগ দিলে তিনিও সেই দলে যোগ দেন।